ইংরেজি ভীতির কারণ এবং সমাধানের উপায়
-----------------------------------------------
আমরা সেটাই সহজে শিখতে পারি যেটা নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করতে পারি। যেমন- একটা- গান শোনার পর সেটা গুনগুনিয়ে গাওয়ার মাধ্যমে আমরা সহজেই বুঝতে পারি যে আমার দ্বারা গানটা হচ্ছে কি হচ্ছে না। একইভাবে, ছবি আঁকা, খেলাধুলো প্রভৃতি বিষয়েও আমরা পরীক্ষানিরীক্ষার সুযোগ পাই বলে আমরা সেটা সহজেই শিখে নিতে পারি।
একদম ছোটোবেলায় সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন রকম পরীক্ষা নিরীক্ষা করার সুযোগ থাকে বলে ছোটোবেলায় অঙ্ক বিষয়ে তেমন কাঠিন্য আমরা অনুভব করি না। কিন্তু বয়স বা শ্রেণী বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যতই অঙ্ক বিষয়টি মূর্ত থেকে বিমূর্তের দিকে অগ্রসর হয় ততই পরীক্ষানিরীক্ষার সুযোগ কমে আসে ফলে অঙ্ক বিষয়টি ক্রমশ কল্পনানির্ভর হতে থাকে এবং ফলস্বরূপ বিষয়টি কঠিনতর হতে শুরু করে।
ভাষাশিক্ষার পদ্ধতিও এর ব্যতিক্রম নয়।
আমরা স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগেই বাড়ি থেকে মাতৃভাষা শিখে আসি। তাই যে শিশুর মাতৃভাষায় দখল যত ভালো সে তত সুন্দর ভাবে ক্লাসে শিক্ষক/ শিক্ষিকার কথা বুঝতে পারে এবং সে এগিয়ে যায়। স্কুলের শিক্ষক/শিক্ষিকাকে সিলেবাসে কথা মাথায় রাখতেই হয়,তাই ক্লাসের প্রতিটি শিক্ষার্থীর কাছে বিষয়বস্তু পরিষ্কার হলো কি না সেটা নিয়ে ভাবার তেমন অবকাশ থাকে না। ফলে কিছু কিছু ছেলেমেয়ের প্রতিটি বিষয়ে কিছু কিছু দুর্বলতা থেকেই যায় এবং এই দুর্বলতা প্রতি শ্রেণীতে গুনোত্তর প্রক্রিয়ায় বাড়তে থাকে। কিছু কিছু শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে তার মাতৃভাষা আর স্কুলের বইয়ের ভাষা আলাদা আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাড়ির ভাষা আঞ্চলিকতাযুক্ত হওয়ার কারণে স্কুলের শিক্ষক/শিক্ষিকার বক্তব্য ঠিকঠাক পরিষ্কার হয় না। অথচ পরীক্ষায় বইয়ের ভাষায় লিখতে হয়, তাই উত্তর জানা থাকলেও অনেক সময় শিক্ষার্থী সেটা ভাষায় প্রকাশ করতে পারে না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই পরীক্ষায় নম্বর কম পায় এবং তার আত্মবিশ্বাস কমে যেতে শুরু করে। ক্লাসেও অনেক সময় দেখা যায় অনেকেই পড়া বুঝতে পারলেও প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে গুছিয়ে বলতে পারবে না ভেবে অনেকে হাত তোলে না। অন্যরা প্রশংসা পায় ফলে পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীরা আরও বেশি করে হীনমন্যতায় ডুবে যায়। এভাবে সে ধীরে ধীরে লেখাপড়া থেকে বিমুখ হয়ে পড়ে।
সিলেবাস আর নম্বরের প্রতিযোগিতায় শিক্ষার্থীরা যেন একটু বেশিই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে। ফলে স্কুলে শিক্ষার্থীদের নিজেদের মধ্যে ভাববিনিময় তেমনভাবে আর হচ্ছে না। খেলাধুলা, কর্মশিক্ষা জাতীয় কিছু ক্লাসে শিক্ষার্থীদের নিজেদের মধ্যে ভাব বিনিময়ের সুযোগ থাকলেও তারা সেটা নিজেদের ভাষায় করে নেয়। কিন্তু শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিষয়ভিত্তিক ভাব বিনিময় সম্ভব হয় না। নম্বরের প্রতিযোগিতা এতই বেশি যে, তাৎক্ষণিক বক্তৃতা বা নিজেদের কোনো অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেওয়া বা মুখস্থবিদ্যার ওপর নির্ভরশীল নয় এমন কোনো বিষয়ে দু’চার কথা লেখা বা বলা- এসব বিষয়ে শিক্ষার্থী- শিক্ষক সকলেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে।
অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকা আছেন যাঁরা ক্লাসে নিজেদের জ্ঞানের বহর প্রমাণ করায় ব্যস্ত থাকেন। তাই, প্রাঞ্জল ভাষায় বিষয়বস্তু উপস্থাপনের পরিবর্তে অনেকে কঠিন বা যে শ্রেণীতে পড়াচ্ছেন সেই শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের পরিনমন(ম্যাচুরিটি)-এর সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ নয় এমন শব্দ ব্যবহার করেন যেগুলো শিক্ষক-শিক্ষিকারা তাঁদের স্তরের মানুষদের সঙ্গে কথাবার্তায় ব্যবহার করে থাকেন। এমন কোনো শব্দের অর্থ যদি কোনো শিক্ষার্থীর জানা না থাকে তাহলে ক্লাসে লজ্জা, ভয় বা আত্মসম্মান হারানোর ভয়ে ক্লাসে জিজ্ঞাসা করা সম্ভব হয় না।
ভাষা মানেই হলো শব্দ নিয়ে খেলা। শব্দের অভাবে তাই খেলাটা জমে না। ফলে সেই ভাষাটার চর্চার প্রতি আগ্রহ কমে আসে। প্রতি শ্রেণীর উপযুক্ত মোটামুটি যতসংখ্যক শব্দ শিক্ষার্থীদের জানা প্রয়োজন সেটা না থাকার ফলে যথাসংখ্যক শব্দের অভাবে ইংরেজি প্রশ্নের উত্তরের জন্য পুরোপুরি মুখস্থবিদ্যায় নির্ভর করা ছাড়া আর উপায় খুঁজে পায় না শিক্ষার্থীরা। আমি আজ পর্যন্ত কোনো স্কুলের পুস্তকতালিকায় English-Bengali Dictionary বা বাংলা-ইংরেজি অভিধানের উল্লেখ থাকতে দেখি নি। শিক্ষার্থীদের হাতের কাছে শব্দের সম্ভার থাকলে তারা স্বাভাবিকভাবেই শব্দ নিয়ে খেলার তাগিদ পাবে এবং ফলস্বরূপ ভাষাটাও ধীরে ধীরে ভালো লাগতে শুরু করবে। ক্লাসে শিক্ষকের ব্যবহৃত অজানা শব্দগুলোও আর সমস্যার কারণ হবে না।
ভাষাশিক্ষার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো সেই ভাষার ব্যাকরণ। ব্যাকরণ হলো ভাষার বিজ্ঞান। তাই ব্যাকরণ যত সুন্দরভাবে বুঝবে ততই ভাষাটার ওপর দখল বাড়বে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, এখনও অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকা সেই আদ্যিকালের নিয়মে -ইয়াছিল, -ইয়াছে, -ইতেছে, -ইতেছ এইসব শব্দগুলো দিয়েই ক্রিয়ার কাল শেখান। তাঁরা নির্দ্বিধায় বলেও দেন যে, ক্রিয়ার শেষে কোন শব্দ থাকলে কোন কাল হবে কিন্তু বাস্তবে কোথাও শিক্ষার্থীরা ওই -ইয়াছি, -ইতেছে ইত্যাদি শব্দগুলো ওই শিক্ষকের দ্বারা তৈরি হওয়া প্রশ্নপত্র ছাড়া আর কোথাও খুঁজে পায় না । ফলে ব্যাকরণের ওই জ্ঞান ব্যবহার করে শিক্ষার্থীরা নিজেদের সম্ভারের শব্দগুলো নিয়ে খেলতে পারে না। তাই ইংরেজি ভাষার সঙ্গে তাদের দূরত্ব ক্রমশই বাড়তে থাকে।
শুধুমাত্র সিলেবাস শেষ করার মাধ্যমে ভাষা শিক্ষা সম্ভব নয়। বাংলা কথা বলার মাধ্যমে যেভাবে শিক্ষার্থীরা বাংলা ভাষাশিক্ষার প্রয়োগ করতে পারে, ইংরেজির ক্ষেত্রে সেটা হয় না। সেটা করার জন্য পাঠ্যবইতে Activity রাখা হলেও সেটা আসলে পরীক্ষার জন্য প্রশ্নোত্তর ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই দায়িত্ব সহকারে ইংরেজি ভাষায় কথা বলার জন্য সপ্তাহে দুয়েকটা ভাষাচর্চার ক্লাস রাখা দরকার।
মাতৃভাষা অর্থাৎ আমাদের ক্ষেত্রে বাংলা ভাষায় পারদর্শিতা যত বেশি হবে অন্যান্য বিষয়েও পারদর্শিতা ততই বাড়বে। কারণ ইংরেজি ছাড়া বাকি সমস্ত বিষয়ের বইগুলো বাংলা ভাষাতেই লেখা থাকে, বাংলায় লেখা হয় ইংরেজি গ্রামারও। যে শিক্ষার্থী নিজে পড়ে নিজের মতো করে বুঝতে পারে তাকে কেউ আটকাতে পারে না। তাই শুধুমাত্র ভাষাচর্চার জন্য, পরীক্ষা আর নম্বরের সঙ্গে যুক্ত নয় এমন কার্যাবলী স্কুলে অবশ্যই দরকার।
আমার মতামত যদি কারো পছন্দ না হয়ে থাকে বা যদি কেউ অন্যরকম কিছু মত পোষণ করেন, তবে আলোচনার পথ সর্বদাই খোলা রইলো। ধন্যবাদ। (স্্ গৃহীত :নিরাপদ পাল মহাশয়)